পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৫

বাবা’কে বিষণ মনে পড়ে! ৩১ডিসেম্বর ২০১৩ইং

১ম মৃত্যু বার্ষিকী
বুঝিনি কবু বাবা এভাবে বিজয় মাসে বিদায় ঘন্টা বাজাবে। যখন বাবা পাশে ছিল এক মূহুর্তেও মনে করিনি বাবা হারিয়ে যাবে। বাবার মৃত্যুর আমন্ত্রণ এতো ঘনিয়ে জানলে তৃপ্তিভরে ‘বাবা’ ডেকে নিতাম। একটানা এক বছর চার মাস আরোগ্যে কোন ডাক্তার কবিরাজ সনাক্তা করতে না পারায় বিভিন্ন ঔষুধ সেবনে ছিলেন ব্যাস্ত আমার বাবা। শারিরীক এতো অসুস্থতার পরও চিন্তা-চেতনা, দেহ-বল ছিল সতেজ। তাঁর চলাফেরা ছিল স্বাভাবিকের ন্যায়। রাতে ব্যাথা যন্ত্রণা বাড়লেও দিনে রীতিমত চালিয়ে যায় তাঁর প্রয়োজনীয় কাজ-কাম। বোঝা যেতনা তিনি একজন অসুস্থ। কোন কাজে খাম-খেয়ালী ছিল না তাঁর। এতো পরিশ্রমী, ধার্মিক, সৎ, সত্যবাদীর পরিচয় দিয়ে গেল আমাদের কাছে। যেমন ছিল গরম মেজাজী তেমন ছিল সাধু, দয়ালু, হৃদয়বান সাদা-মাটা। মিষ্টি কথায় কারো মন ভোলার চেয়ে তিক্ত কথায় স্পষ্টবাদী তাঁর স্বভাব। সুতরাং যার দরুণ লোকের কাছে তেমন প্রিয় হয়ে উঠেনি। কোন বদঅভ্যাস, অপব্যায়ে মগ্ন ছিল না। তাঁর অসাধ্য চেষ্টায় আমাদের এত বড় সংসারে অভাবের ছোঁয়া লাগেনি। সংসারে ৬ভাই ৩বোন কে গড়েছে মানুষ করে। বাবা হয়ে ঋণী থাকেনি সন্তানের কাছে। ‘মা’ আর ‘বাবা’ ডেকে তৃষ্ণা মিটেনী। মনে করেছিলাম মা’ই শুধু পাষান বাবার হাতে তুলে দিয়ে আমাদের অসহায় রেখে বিদায় দিল। কিন্তু দেখি বাবা, মায়ের চেয়ে কম পাষাণ নয়। সে ও কিভাবে একাকী ফেলে চলে গেল আমাদের নিঃস্ব করে। ডিসেম্বর নজিরবিহীন বাংলার বিজয় এবং স্বাধীনতার মাস হিসেবে বাঙ্গালীর মনে আবেগাপ্লুত স্মৃতির শোক বয়ে যায় যুগ যুগ ধরে। সেই ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে ঝরে যায় বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত একটি পূর্ণাংগ বছর আর সূচনা হয় সজ্জিত নতুন বছর। বাবাও কি সে অবিকলে সমাপ্তি ঘটাল বিজয় মাস এবং অতিবাহিত একটি সম্পূর্ণ বছর আর নতুন বছরের আগমনে! নয় মান যুদ্ধে ত্রিশ হাজার মা-বোনের ইজ্জত আর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বর বিজয় মাসের উড্ডয়ন, লাল বৃত্তিকায় সবুজ পতাকা উদয়নে ব্যাথা-বেদনাহত মুক্তমনায় হাসি উৎফুল্ল সারা বাংলা ডিসেম্বরের আগমনে । বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনতে যেমন ছিল কষ্টের ফল তেমনি বিদায় বেলা আরও বেদনাদয়ক। সে ডিসেম্বর বিদায়বেলা কেড়ে নিয় যাই আমার প্রাণপ্রিয় ‘বাবা’কে। ৩১ তারিখ রাত ১২টা পার হয়ে ১তারিখে যখন পা দেয় বাবার বিদায় ঘন্টা বাজে। ভোর না হতে বাবা পরিবারের সবার (প্রত্যেক সন্তানের) কাছে দায়িত্ব তুলে দিয়ে সুস্থভাবে বিদায় নেয়। সবাই কান্নায় কলরোলে পাগলপারা। এই কি বাস্তব বিশ্বাসের অযোগ্য অশ্রুজলে সিক্ত প্রত্যেকে। বিজয়মালায়  ডিসেম্বর বাঙ্গালীর মনে যেমন গৌরব জন্মালো তেমনি আর একটি ইতিহাসের সূচনা ঘটালো বাবা’র নিশির রাতে চিরনিদ্রায়। এই দিনটিতে অশ্রুজলে সিক্ত, বেদনায় মক্ত ছাড়া আর কিছু দেবার নাই বাবা তোমাকে। 

শিকের ওপারে বাবাকে শুধু দেখেছি...কোলে উঠতে পারিনি -

আমি নুমায়ির। নামিরার ভাই। আমার বয়স সাত দিন। নুমায়ির আমার ডাকনাম। বাবা আমার নাম না রাখতে পারলেও অনলাইনেই আমার একটি নাম দেয়া হয়েছে- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ। প্রখ্যাত সাহাবীর নামেই আমার এ নাম। মাসুদ আমার বাবা। আমি উনাকে দেখেছিলাম না। আজ দেখেছি। সাধারণত ছেলে সন্তান জন্মের পরে সন্তানের কানের পাশে নাকি আযান দেয়া হয়। সচরাচর পিতাই আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে আযান দিয়ে থাকেন। আমার বাবাও সেরকমই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু পারেননি। কারন উনি বাসায় ছিলেন না।
এক দিন দুই দিন করে করে ছয়টি দিন পার হয়ে গেল। কিন্তু বাবা আসছিলেন না। অনেকেই বাসায় আসলেন। আমাকে কোলে নিলেন। আমাকে সবাই কেন যেন একটু বেশী করে আদর করছেন। কিন্তু জানেন, আমার সব আদরের পরেও কেন যেন একটি অতৃপ্তি কাজ করছিল। কি সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ছোট তো, তাই কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলাম না।
সবাই আমার ছবি তুললেন। আদর করে ফেসবুকেও আমার ছবি পোস্ট করলেন চাচ্চুরা, খালামনিরা। যারা আমাদের বাসায় আসতে পারেননি, তারাও আমাকে দেখলেন। কমেন্টে অনেকেই অনেক দোয়া করেছেন। অনেকে নাকি আমাকে দেখে চোখের পানিও ফেলেছেন। আল্লাহর কাছে আমার জন্য অনেক দোয়া করেছেন।
আজ এক সপ্তাহ পরে মামনি আমাকে নিয়ে বাইরে গেলেন। ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এক সময় একটি বড় দালানের কাছে পৌঁছলাম আমরা। কী জানি কোথায় যাচ্ছি আমরা! তবে এক ধরনের অজানা ভাল লাগা আমার মধ্যে কাজ করছিল। আমিতো আসলে জানিনা, আমরা কোথায় যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত আমরা ভেতরে গেলাম। কিছুক্ষন পরে লোহার শিকের ওপাশ থেকে একজন আমাকে ডাকলেন। আমি আধো আধো চোখ খুলে তাকালাম। খুব নজর করে খেয়াল করলাম। প্রথম দেখাতেই খুব ভাল লাগল। এক ধরনের অনুভূতি খেলা করে গেল ভেতরে। খেয়াল করলাম- উনার চোখের পানি বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু উনি দৃঢ়তার সাথে তা আটকে রাখতে চাইছেন। মা আমাকে উচু করে ধরলেন। বললেন- দেখ, বাবাকে। আমার মনে পড়ে গেল এ কোলের জন্যই তো আমার অপেক্ষা ছিল। ইনিই আমার বাবা! বাবা, আমিতো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি ক’দিন ধরে। আমি ভাবলাম, এবার বাবা আমাকে কোলে নেবেন। অতৃপ্তি বোধ হয় কিছুটা মিটবে। আমি অপেক্ষা করলাম। কিন্তু জানেন, বাবা আমাকে কোলে নিলেন না। কিভাবে নেবেন, কালো শিকের কারনে বোধ হয় আসতে পারছেন না। বলতে চাইলাম, বাবা শিকের এপাশে আসো। আমিতো তোমার জন্য হাত বাড়িয়ে আছি...
বাবা এবার আর পারলেন না। শব্দ করে ডুকরে কেঁদে ফেললেন। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, উনার চোখেও পানি।। আর বোন নামিরার দিকে খেয়াল করলাম। না, ও কিছু বুঝছেনা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কালো শিকগুলো ধরে ও শুধু ঝাকাচ্ছে। ওর বয়সও তো বেশী না। তাই শিকগুলো ও ভাংতে পারছেনা। আমি আরেকটু বড় হলে এ শিক ভেঙ্গে বাবার কাছে যেতাম। আমি বাবার চোখের পানি মুছে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার হাত তো ছোট। শিক পার হবেনা। তাই, বাবাই পরক্ষনে চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন... বাবার হাসিটা না খুব মিষ্টি!
বাবা হাত বাড়ালেন। আমার মাথায় হাত বুলালেন। কী পরম তৃপ্তি বাবার হাতের স্পর্শে...। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে কিছু কথা বললেন। সে কথাগুলো বোধ হয় বাবার এতোদিনের সংরক্ষিত অনুভূতির ফসল। উনি বললেন- "দেখে রাখ জালিমের জেলখানা, আসতে হতে পারে তোমারও, এই আন্দোলনের ডাকে সারা দিয়ে"। আমি বলতে চাইলাম- বাবা, তুমি শুধু দোয়া কর। তোমার এ আন্দোলনের পথে যেন আমিও যথাযথভাবে পা বাড়াতে পাড়ি। আমার নামের স্বার্থকতা যেন আমি রাখতে পারি। তোমার মত সাহসী যেন হতে পারি, বাবা।
চলে এলাম বাবার আদেশ মিশ্রিত নির্দেশনাকে বুকে ধারন করে।
সবার কাছে দোয়া চাইছি। আমি যেন ধৈর্য ধারন করতে পারি। আর বাবা যেন খুব দ্রুত আমার কাছে চলে আসতে পারেন।

(নুমায়িরের অনুভূতি হয়তবা এমনই হবে। মাসুদ ভাইয়ের সাথে জেলখানায় তাঁর সন্তানের সাক্ষাতের ছবিটি দেখে খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম সদ্যজাত এ নুমায়িরের অনুভূতির ব্যাপারে। সে কল্পনাকেই লিখতে চেষ্টা করেছি মাত্র-